বুলিং মানে টিটকারি বা কটু কথা বলা। সাইবার বুলিং মানে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা উন্মুক্ত কোনো প্ল্যাটফর্মে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো কিংবা এমন আচরণ করা যা মানসিক নির্যাতনের পরিস্থিতি তৈরি করে। অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগেন৷ এদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷

একটা সময় বলা হতো, ছুরির আঘাতের চেয়ে মানুষের জিহ্বার আঘাত মারাত্মক। কারণ, ছুরির আঘাতের ক্ষত এক সময় শুকিয়ে যায়। কিন্তু মুখ দিয়ে অন্তরে যে আঘাত করা হয় তার ক্ষত শুকায় না। এখন মানুষের মুখের কটু কথার চেয়ে ভয়ঙ্কর ‘সাইবার বুলিং’। এই ধরনের আঘাতে মানুষের শরীরে কাটা-ছেঁড়া কিংবা রক্তাক্ত না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

সাইবার বুলিংয়ের ফলাফল এতো ভয়াবহ হওয়ার কারণ হলো কেউ কাউকে সরাসরি বা মুখোমুখি কিছু বলে কষ্ট দিলেও পরে কোনো সময় তা দুই পক্ষই ভুলে যেতে পারে। কিন্তু ইন্টারনেটে কাউকে হেয় করে কিছু প্রচার হলে এটি থেকে যায় বছরের পর বছর। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম কিছু প্রচার হলে তাতে প্রতিক্রিয়া জানানো, লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের মাধ্যমে মুহূর্তে ভাইরাল হয়। এই ধরনের কনটেন্ট (লেখা, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি) পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকেউ দেখতে পারে এবং সহজেই দ্রুত প্রচার করতে পারে।

বছর ঘুরে এলে আবার একই সময়ের পোস্ট স্মরণও করিয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর ফলে বার বার নেতিবাচক একটা বিষয় চোখের সামনে এসে বিরূপ মনোভাব কিংবা অসহ্যকর মানসিক অবস্থা তৈরি করে। ঘটনা যদি এমন হয় যে, কাছের কোনো মানুষের সঙ্গেও শেয়ার করা যাচ্ছে না, তখন ভুক্তভোগী ব্যক্তির দমবন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ক্ষেত্র বিশেষে আত্মহননের পথও বেছে নেওয়ার উদাহরণ আছে অনেক। কিন্তু তারা তখন বুঝতে চায় না যে, আত্মহনন কখনোই এমন পরিস্থিতির সমাধান নয়।

গবেষণা যা বলছে: 
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির একটা পরিসংখ্যান বলছে, ইন্টারনেটে হয়রানির শিকার হয়ে বছরে ১১ জনের মৃত্যু হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ১৮-৩০ বছর বয়সীরা।  বছর চারেক আগে প্রকাশিত টেলিনর গ্রুপের এক গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের ইন্টারনেটে সহজে প্রবেশাধিকারের কারণে বাবা-মায়েদের কাছে আলোচিত ও শঙ্কার একটি বিষয় হচ্ছে, সাইবার বুলিং। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৯ শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থীর একই ব্যক্তির দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হওয়া অথবা অনলাইনে উত্ত্যক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অথবা তারা নাম প্রকাশ না করে অনলাইনে অন্যকে উত্ত্যক্ত করেছে। এ গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্ধেকের কম স্কুল শিক্ষার্থী অনলাইনে এ ধরনের সমস্যায় যখন বুঝতে পারে না কীভাবে এর সমাধান করবে, তখন তারা এর সমাধানের জন্য বাবা-মা ও শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করে। জরিপকৃত শিক্ষার্থীর মাত্র ৩৮ শতাংশ জানায়, তারা এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশ সাইবার হয়রানির মুখে পড়ছে৷ ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের তথ্যমতে, ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷ সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, নারী-শিশু ও তরুণরা এ ধরনের অপরাধের বেশি শিকার হচ্ছে।

আপনার আচরণ কাউকে আহত করছে না তো?
আমাদের মনে রাখা উচিত, ইন্টারনেটে আমি ব্যক্তিগতভাবে যাই করছি তার ফলাফল কিন্তু সমষ্টিগত। অর্থাৎ আমার একজনের কাজের প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বের যেকোনো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ওপর। সেটি ভালো কিংবা মন্দ দুটোই হতে পারে। তাই আমাদের উচিত, ইন্টারনেটে এমন আচরণ বজায় রাখা যা আমার বেলায় অন্য কেউ করলেও আমি পছন্দ করব।

কাউকে আহত করে কোথাও প্রকাশ্যে মন্তব্য করা, যেকোনো কিছু পেলেই হুট করে যাচাই ছাড়া শেয়ার দেয়া, কারো মানসিক চাপ তৈরি হয়- এমন কিছু ব্যক্তিগতভাবে কাউকে উল্লেখ করে পোস্ট দেওয়া– এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।

যে বিষয়টি সব সময় মনে রাখা দরকার 
মনে করুন আপনার এলাকায় একটি বিষয় খুবই অস্বাভাবিক। সেটা করা একদম বেমানান। আবার একই বিষয় অন্য কোনো এলাকায় স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ভার্চুয়াল জগত পৃথিবীর সব মানুষকে এক জায়গায় একত্রিত করছে। এখানে কেউ কিছু পোস্ট করল, আর আপনি হুট করে সেটির বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগলেন, তাকে তুলোধুনো করছেন? এমনটা মোটেই উচিত নয়।

অন্যের মতামত বা আচরণের প্রতি সহনশীল মনোভাব তৈরির চর্চা করতে হবে আমাদের। কোনো কিছুর সঙ্গে দ্বিমত হলে সেটি যৌক্তিকভাবে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে বলুন। তাহলেই আমরা ভার্চুয়াল জগতে বসবাসকারীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে পারবো।

তবে হ্যাঁ, পৃথিবীর সব মানুষের জন্যই পথ দুটো- সত্যা আর মিথ্যা। অবশ্যই শেষ দিন পর্যন্ত এই সত্য-মিথ্যার লড়াই অব্যাহত থাকবে। আর সেটি যেন হয় শান্তিপূর্ণ, এই দিকটি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

প্রতিকারে আইনি ব্যবস্থার প্রতি অনীহা  
প্রতিকার বা সুরক্ষার বিষয়ে বলার আগে যে কথাটি বলা দরকার তা হলো- ৭০০ কোটির মানুষের বিশ্বে আমরা যে কেউ এ ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হতে পারি, কিংবা যে কেউ অপরাধী হতে পারি। কারণ, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের কল্যাণে সারা পৃথিবীর মানুষ একটি প্ল্যাটফর্মে এসে জড়ো হচ্ছি আমরা। তাই বাস্তব জগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের প্রতিরক্ষার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে আমরা প্রত্যেকে নিজেই নিজের রক্ষক। এখানে নিজে সচেতন বা সতর্ক না থাকলে রক্ষা করার কেউ নাই।

এরপরও এখানে কোনো ক্ষতির শিকার হলে প্রয়োজন এর বিরুদ্ধে দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। যত দেরি করবেন ততই ক্ষতির মাত্রা বাড়বে এবং অপরাধীর পদচিহ্ন শনাক্ত করা কঠিন হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আইনি ব্যবস্থা নেন না বা নিতে চান না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগীদের ৮০ দশমিক ৬ শতাংশই কোথাও অভিযোগ করেন না। এর বড় কারণগুলোর মধ্যে সামাজিকভাবে বিষয়টি গোপন রাখা, প্রতিকার পাওয়ার বিষয়ে আস্থা না থাকা, আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির ভয় এবং ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় না জানা উল্লেখযোগ্য।

আইনি ব্যবস্থা নিতে অনীহা তৈরির পেছনে অবশ্য আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থারও দায় আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বড় একটি অংশ (১৯ দশমিক ৩ শতাংশ) হয়রানি এড়াতে আইনের আশ্রয় না নেওয়াকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে অবশ্যই রাষ্ট্রের চালকদের করণীয় আছে এবং যত দ্রুত তা করা যায় ততোই সবার জন্য মঙ্গল।

তবুও সুরক্ষার জন্য যা করতে হবে 
এতকিছুর পরেও বলবো ভুক্তভোগীদের আইনি প্রতিকারের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এ ধরনের অপরাধের শিকার হলে সবার আগে পরিবার কিংবা কাছের মানুষের সঙ্গে বিস্তারিত খুলে বলুন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে যোগাযোগ করতে হবে।

ঘটনা যেমনই হোক দ্রুত আপনার কাছের থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করুন। এমনকি প্রাথমিকভাবে আপনার বিষয়টি সমাধান হয়ে গেলেও সমাধানের কথা উল্লেখ করে একটি জিডি করতেই পারেন। এটি ভবিষ্যতে আপনাকে দ্বিতীয়বার ক্ষতির মুখে পড়া থেকে রক্ষায় কাজে দেবে। জিডির আবেদনে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে বলার চেষ্টা করুন। অপরাধ ও অপরাধীকে শনাক্ত করার বিষয়গুলো যতবেশি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যায় (যেমন: ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফোন নম্বর, ইমেইল ঠিকানা, নির্দিষ্ট সময় ও তারিখ, ওয়েব লিংক, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি)। প্রয়োজনে সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো ভালো বুঝেন এমন কোনো ব্যক্তি বা আইনজীবীর সহযোগিতা নিন।

নিকটস্থ থানায় আশানুরূপ সহযোগিতা না পেলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগ করতে পারেন। ফেসবুকে  facebook.com/cpccidbdpolice এই ঠিকানায় যোগাযোগ করা যায়। ফোনে 01730336431 নম্বরে এবং ইমেইলে cyber@police.gov.bd ঠিকানায় যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে।

সবসময়ই নতুন প্রযুক্তি আসছে আমাদের সামনে। তাই নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতার বিষয়গুলোর নতুন তথ্য জানতে সিসিএ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে (ccabd.org) ও ফেসবুক পেজে (facebook.com/pageCCA) নিয়মিত চোখ রাখতে পারেন।

লেখক: সভাপতি, সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন